• প্রকাশিত : ২০২০-১১-১০
  • ৬৭৭ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

তিন দশক আগের আলোচিত সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার বিচার শিশু আদালতে চেয়ে আসামি মারুফ রেজার রিভিশন আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত গত ৭ সেপ্টেম্বর এই মামলার বিচার শিশু আদালতে স্থানান্তরের আবেদন খারিজ করে দেয়।
বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দ সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চে রিভিশন আবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
আদালত আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে আজ খারিজ করে দিয়েছে।
আদালতে আসামির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী দেওয়ান আবদুন নাসের ও আবুল কালাম আজাদ। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল মো. মনিরুল ইসলাম, সহকারী এটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও ফরিদা পারভীন ফ্লোরা।
১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাইয়ের ঘটনা। সেদিন সগিরা মোর্শেদ সালাম রিকশা করে ভিকারুননিসা নুন স্কুল থেকে তার মেয়েকে আনতে যাচ্ছিলেন। বিকাল ৫টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী রোডে পৌঁছামাত্র মোটরসাইকেলে থাকা দুই যুবক সগিরা মোর্শেদ সালামের হাতে থাকা স্বর্ণের চুড়ি ও হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় তিনি বাধা দেন এবং একজনের নাম বলে বলেন, ‘এই আমি তো তোমাকে চিনি, এখানে কেন তুমি ?’ এরপরই মোটরসাইকেলে থাকা এক যুবক সগিরা মোর্শেদকে লক্ষ্য করে পর পর দু’ রাউন্ড গুলি করে। একটি গুলি সগিরার ডান হাতে এবং আরেকটি তার বাম বুকে বিদ্ধ হয়।তার চিৎকারে আশেপাশে লোকজন জড়ো হতে থাকলে দুবৃত্তরা ফাঁকা গুলি করতে করতে দ্রুত পালিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় সগিরাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ঘটনার দিনই অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করেন নিহতের স্বামী সালাম চৌধুরী। এ মামলার তদন্তকালে মিন্টু ওরফে মন্টু এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজা গ্রেফতার হয়। কিন্তু মারুফ রেজার নাম বাদ দিয়ে পুলিশ চার্জশিট দেয়। তবে সাক্ষ্যে মারুফ রেজার নাম আসায় অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন বিচারিক আদালত। কিন্তু অধিকতর তদন্তের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন মারুফ রেজা। সে রিভিশন আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশ ও বিচার কাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। সেই সঙ্গে তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এরপর ১৯৯২ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে বলে আদেশ দেন। এরপরই প্রকারন্তে থেমে যায় এই মামলার সব ধরণের তদন্ত কাজ। তবে মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা হত্যা মামলার বিষয়টি এটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের নজরে আনলে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। পরবর্তিতে বিষয়টি আবার হাইকোর্টে তোলা হয় এবং গত বছরের ২৬ জুন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত করে জারি করা আগের রুলটি খারিজ করে রায় দেন। সেই সাথে হাইকোর্ট তার রায়ে এ মামলাটির অধিকতর তদন্ত ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে ৯০ দিনের মধ্যে মামলাটির বিচার শেষ করার নির্দেশ দেয় আদালত।
হাইকোর্টের ওই রায়ের ফলেই ২৮ বছর ধরে ফাইলবন্দি থাকা হত্যা মামলাটি নতুন করে প্রাণ পায়। এরপরই পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে মামলাটি পিবিআইয়ের কাছে যায়। এরপর পিবিআই হত্যার ঘটনার সময়কার রিক্সাচালক ও ঘটনাস্থলের আশেপাশের দোকানিদের সাথে কথা বলে আবদুস সালাম নামের এক রিক্সাচালককে খুঁজে বের করে। পরবর্তীতে এই আবদুস সালামই হত্যাকান্ডে জড়িত দুই ব্যক্তির শারীরিক বর্ণনা দেন এবং রিকশায় থাকা অবস্থায় সগিরা মোর্শেদের বলা কথার বিষয়টি পিবিআইকে জানান। অন্যদিকে, পারিবারিক কলহের জেরে যে এই হত্যাকান্ডটি সংগঠিত হয়েছে সে বিষয়টি জড়িত দু’জনের শারীরিক বর্ণনা ও বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষ্যে পিবিআইয়ের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। পিবিআই তদন্তে উঠে আসে যে, ঢাকার রাজারবাগে পৈত্রিক বাড়ির নীচতলায় সালাম চৌধুরীর বড় ভাই সামসুল আলম চৌধুরী থাকতেন। আর দোতলায় থাকতেন সগিরা-সালাম চৌধুরী দম্পতি এবং তাদের তিন মেয়ে। আর সালাম চৌধুরীর মেঝ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার স্ত্রী-সন্তানসহ লিবিয়া থেকে ১৯৮৫ সালে দেশে ফেরার পর কিছুদিন নীচ তলায় থাকেন। এরপর তারা দ্বিতীয় তলায় সালাম দম্পতির বাসার একটি রুমে থাকেন। তখন থেকেই ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী শাহিনের সঙ্গে সগিরার বিভিন্ন বিষয়ে কলহ শুরু হয়। একপর্যায়ে ওই বাড়ির তৃতীয় তলার কাজ সম্পন্ন হলে ডা. হাসান তার পরিবার নিয়ে তৃতীয় তলায় ওঠেন। এরপর বিভিন্ন সময় তৃতীয় তলা থেকে আবর্জনা ফেলাসহ নানা কারণে শাহিনের সঙ্গে সগিরার (দুই জা’য়ের) দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকে। এক পর্যায়ে সগিরা মোর্শেদকে ‘শায়েস্তা’ করতে হত্যার পরিকল্পনা করেন হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী শাহিন। এরপর ২৫ হাজার টাকায় মারুফ রেজার সঙ্গে চুক্তি করে। পরবর্তিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই দুপুরে ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজওয়ানকে ফোন করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলেন এবং মারুফ রেজার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। রেজওয়ানের সঙ্গে মোটর সাইকেল করে মারুফ রেজা সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরের কাছে অপেক্ষা করতে থাকেন। এরপর ওইপথে সগিরাকে রিকশায় করে আসতে দেখে তারা কিছুদূর অনুসরণ করার পর সগিরার রিকশার পথ আটকান এবং সগিরা মোর্শেদের হাতে থাকা স্বর্ণের চুড়ি ও হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় সগিরা মোর্শেদ বাধা দেন এবং বলেন, আমি তোমাকে চিনি। তুমি রেজওয়ান, এখানে কেন তুমি?’ এরপরই সগিরা মোর্শেদকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।
গত বছরের ১০ নভেম্বর রেজওয়ানকে (ডা. হাসান আলী চৌধুরীর শ্যালক) গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। এরপর গ্রেফতার করা হয় ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনকে। আর গত বছরের ১৩ নভেম্বর গ্রেফতার হন মারুফ রেজা। এরপর হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন তারা। পরে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে সগিরার ভাসুরসহ চারজনকে আসামি করে এক হাজার ৩০৯ পৃষ্ঠার অভিযোগত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম। সর্বশেষ আজ সোমবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজকে এম ইমরুল কায়েশের আদালত সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলায় তার ভাসুরসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানির জন্য ২৬ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
#
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat