নিজস্ব প্রতিনিধি:- অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বিশাল বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন। এটি উপস্থাপনের আগে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়। এর পর অনুমোদন নেওয়া হয় রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের। এর মধ্য দিয়ে ১২ বার বাজেট দেওয়ার রেকর্ড স্পর্শ করলেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উচ্চতর প্রবৃদ্ধি এবং অপ্রতিরোধ্য গতিতে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি সব ধরনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বড় অঙ্কের আয়ের লক্ষ্য অর্জনের যৌক্তিকতা তুলেন ধরেন।
বাজেটে মোট আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা আর ঘাটতি ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা যা মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এই ঘাটতি মোট বাজেটের চার ভাগের এক ভাগ। মোট আয়ের মধ্যে আয়কর ১ লাখ ২ হাজার ২০১ কোটি টাকা। মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১ লাখ ১০ হাজার ৫৪৩ কোটি। সম্পূরক শুল্ক ৪৮ হাজার ৭৬৬ কোটি, আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক ৩২ হাজার ৫৮৯ কোটি, আবগারি শুল্ক ২ হাজার ৯১ কোটি, টার্নওভার ট্যাক্স ১১ কোটিসহ এনবিআরকে আদায় করতে হবে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। অন্যদিকে কর ব্যতীত রাজস্ব ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি, এনবিআরের বাইরে আদায় ৯ হাজার ৭২৭ কোটি, বিদেশি অনুদান ৪ হাজার ০৫১ কোটি।
চলতি ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী বাজেটে ঘাটতি বেশি ১৩ হাজার ১৮ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতির বাইরে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশি অনুদান পাবেন বলে ধরে নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, অনুদান পাওয়ার আশা কোনো সময়ই পুরোপুরি পূরণ হয় না। ফলে অনুদানের ওই অর্থ পাওয়া না গেলে শেষ পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকায়। বরাবরই বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রী দুটি উত্স বেছে নেন। একটি বৈদেশিক উত্স এবং অন্যটি অভ্যন্তরীণ উত্স। অভ্যন্তরীণ উেস রয়েছে আবার দুটি ভাগ সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ব্যবস্থা। আগামী বাজেটে ঘাটতি পূরণের জন্য বড় উত্স হিসাবে ভাবা হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থাকে। আর কমিয়ে আনা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা। চলতি অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী বিদেশ থেকে অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে মোট ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। আগামী অর্থ বছরে বিদেশি উত্স থেকে অনুদান গ্রহণের লক্ষ্য বাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ১৭টি খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১০টি খাত হচ্ছে পরিবহন খাতে ৪৫ হাজার ৪৪৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যুত্ খাতে ২২ হাজার ৯৩০ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ ভৌত-পরিকল্পনা-পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ খাতে ১৭ হাজার ৮৮৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনয়ন এবং অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য চতুর্থ সর্বোচ্চ পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতে ১৬ হাজার ৬৯০ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। শিক্ষার প্রসার ও গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষা ও ধর্ম খাতে পঞ্চম সর্বোচ্চ বরাদ্দ ১৬ হাজার ৬২০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যা ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণসহ তথ্য প্রযুক্তির প্রসারে বিজ্ঞান,তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ১৪ হাজার ২১০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, যা ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য-পুষ্টি-জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ খাতে বরাদ্দ ১১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা, যা ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে কৃষি খাতে বরাদ্দ ৭ হাজার ৭৬ কোটি ২২ লাখ টাকা, যা ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। নদী ভাঙন রোধ ও নদী ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পানি সম্পদ সেক্টরে বরাদ্দ ৪ হাজার ৫৯২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, যা ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মানব সম্পদ উন্নয়নসহ দক্ষতা বৃদ্ধিতে গতিশীলতা আনয়নে জনপ্রশাসন খাতে বরাদ্দ ৩ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১০ মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে, সর্বোচ্চ বরাদ্দ স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুকূলে ২৩ হাজার ৪৩৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ বিদ্যুত্ বিভাগের অনুকূলে ২২ হাজার ৮৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অনুকূলে ২০ হাজার ৮১৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর পর পর্যায়ক্রমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১১ হাজার ৭২০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, রেলপথ মন্ত্রণালয় ১১ হাজার ১৫৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা, সেতু বিভাগে ৯ হাজার ১১২ কোটি ১৫ লাখ টাকা, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে ৯ হাজার ৪০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৮ হাজার ৩১২ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে ৬ হাজার ৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুকূলে বরাদ্দ করা হয়েছে ৫ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ ও দেশে সঞ্চয়পত্র বিক্রি-এ দুটি ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অর্থনীতিবিদদের। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পাইপলাইনে অনেক প্রতিশ্রুতি সত্বেও আমরা স্বল্প সুদের বিদেশি ঋণ ওইভাবে আনতে পারি না শুধু দক্ষতার অভাব ও শর্ত মানার বাধ্যবাধকতার কারণে।