কোরআন অনুবাদের ভুল সংশোধনে প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী নির্দেশ
কোরআনের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থগুলোর ভুল সংশোধন ও ব্যাখ্যার ভিন্নতা পরিহার করে যথাসম্ভব অভিন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই নির্দেশ অনুযায়ী ইতোমধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন সংশোধনের কাজ শুরু করেছে। এছাড়া কোরআনের অনুবাদ ত্রুটিমুক্ত রাখতে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সৌদি আরব বা মিসরের আল আজহারের মতো বাংলাদেশে এমন একটি প্লাটফরম গড়া অভাবনীয় হলেও অসম্ভব নয়। কোরআন ডিজিটালাইজেশন ও আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের পর কোরআনের অনুবাদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত নির্দেশনার বাস্তবায়ন হলে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে।
বলা হয়, কোরআনের অনুবাদ যত শুদ্ধই হোক, শতভাগ বিশুদ্ধ অনুবাদ সম্ভব নয়। এর কারণ ভাষাগত সীমাবদ্ধতা। কোরআন বোঝার জন্য অনুবাদের বিকল্প নেই। কিন্তু অনুবাদের একটু হেরফের হলে স্বয়ং আল্লাহতায়ালার কথাই বিতর্কিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। বাংলা বা উর্দুতে কোরআন অনুবাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আরবি থেকে সরাসরি অনুবাদ না হয়ে ফার্সি থেকে উর্দুতে এবং উর্দু বা ফার্সিতে অনুবাদকৃত কোরআন থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছিল। ফলে উর্দু ও বাংলা উভয় ভাষার অনুবাদেই শাব্দিক, ভাষাগত ও ব্যাখ্যার তারতম্য ঘটেছে। শেখ হাসিনা বাংলায় ও আরবিতে কোরআনের ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে যুগান্তকারী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। ফলে অনলাইনে সহজেই কোরআন পড়া ও এর তেলাওয়াত শোনা যায়। এবার অনুবাদের অসামঞ্জস্যতা দূরীকরণে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তার মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষার প্রসারে আবারও প্রধানমন্ত্রীর গভীর আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারতের প্রাক্কালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন। লাইব্রেরিতে দায়িত্বরত উপ-পরিচালককে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে কোরআনের অনেক অনুবাদ গ্রন্থ আছে। সেসব গ্রন্থের অনেক জায়গায় একই আয়াতের বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা আছে। আপনি মহাপরিচালককে বলবেন, আমাদের দেশের অনুবাদের যদি ভুল-ত্রুটি থাকে, এটা ঠিক না।’ প্রধানমন্ত্রী নিজে কিছু অসামঞ্জস্যপূর্ণ অনুবাদ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন বলে উল্লেখ করে আলেমদের নিয়ে অনুবাদগুলো সংশোধনের নির্দেশ দান করেন।
আল কোরআন অনুবাদের ইতিহাসে দেখা যায়, নবী করীম (স) এর ইন্তিকালের প্রায় ৩৫০ বছর পর ইরানে কোরআনের ফার্সি অনুবাদ হয়েছিল। তবে বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি পর্যন্ত ভুল অনুবাদের কারণে বিতর্কিত বার্তা প্রচার হতে পারে, এই ঝুঁকির কারণে আলেমগণ অনুবাদ করার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। তাতারি, হাউসা, বামুম বা তুর্কি ভাষার মতো সমৃদ্ধ ভাষাতেও তত্কালীন সুলতানগণ অনুবাদের উদ্যোগ বন্ধ করতে বাধ্য হন। কিন্তু কোরআনের শাশ্বত বাণী অনুধাবনের জন্য অনুবাদ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
ইংরেজিতে কোরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ হয় ১৭৬৪ সালে। পরবর্তীতে তাবারী ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ ফার্সিতে অনুবাদ করেন। বাংলা ভাষায় ১৮৮৫ সালে গিরিশ চন্দ্রের অনুবাদের আগে, ১৭৭৯ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র কোরআনের এক পারা অনুবাদ করেছিলেন। ১৭৮০ সালে শাহ আবদুল কাদেরের অনূদিত কোরআন ছিল উর্দু অনুবাদের বাংলা। এ ধারায় পরবর্তীতে শাহ্ রফিউদ্দীন, মাওলানা নায়ীমুদ্দী মৌলভি নঈমুদ্দিন, শেখ আবদুর রহীম, আব্বাস আলী, আবদুল হাকিম, আলী হাছান প্রমুখের নেতৃত্বে কোরআনের অনুবাদ হয়। বর্তমানে কোরআনের বাংলায় অনুবাদগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ১৫টি।
এ উপমহাদেশে কোরআনের অনুবাদের ক্ষেত্রে ফার্সি ও উর্দুর প্রভাব লক্ষণীয়। তবে জটিলতা সৃষ্টি হয় মূলত অর্থের উপলব্ধিগত পার্থক্যের জন্য। এক্ষেত্রে ধর্মীয় মতাদর্শও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এছাড়া তাফসীরের ক্ষেত্রে জাল বা দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে দেওয়া ব্যাখ্যার কারণে অনেক নামকরা তাফসিরেরও সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পায়। অন্যদিকে এমন তাফসির গ্রন্থও আছে, যেখানে বাইবেলের প্রভাব ও মনগড়া ব্যাখ্যার আধিক্য এতই বেশি যে সম্পূর্ণ কোরআনকে নিজের ভাষায় বর্ণনা করে ভিন্ন একটি মতাদর্শ প্রচারের অপচেষ্টা চলেছে। তাই অর্থগত ও মুদ্রণগত ভুল সংশোধন করা সময়ের প্রয়োজন। একইভাবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ও অর্থ প্রকাশ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত প্লাটফর্ম হতে পারে নির্ভুল অনুবাদের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
কোরআনের বাংলা অনুবাদকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের যে সীমাবদ্ধতা ছিল তার উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্ববহ। ইফা সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর ইতোমধ্যেই তারা কাজ শুরু করেছেন। এই কাজটি চলছে প্রতিষ্ঠানটির অনুবাদ বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে। এরপর অনুবাদ বিষয়ে অভিজ্ঞদের কাজে লাগানো হবে। তাদের সংশোধনী পাওয়ার পর সিনিয়রদের একটি গ্রুপ করে আবার যাচাই-বাছাই করা হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভিন্ন সামপ্রদায়িক, জঙ্গিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের অপচেষ্টা করেছে। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করতে মনগড়া মতবাদও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তরুণ ও কিশোরদের মাঝে। ইসলামের অসামপ্রদায়িক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও শান্তির বাণী প্রচার, ইসলামি শিক্ষার প্রসার ও ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতদের মূল ধারায় আনাসহ জঙ্গিবাদ দমনে শেখ হাসিনার সরকার প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর অপতত্পরতা সত্ত্বেও সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি সুরক্ষায় বাংলাদেশ একটি মডেল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী কোরআনের বিশুদ্ধ বাংলা অনুবাদ করতে যে প্ল্যাটফর্ম গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন তার আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়া হলে সৌদি আরব বা আল আজহারের মতো বাংলাদেশও আবির্ভূত হবে ইসলামি শিক্ষার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হিসেবে।